রবিবার, ১ মার্চ, ২০০৯

‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের ভুমিকা’

নাজমুস্ সাকিব অনু
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (৩য় বর্ষ)
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাভার,ঢাকা-১৩৪২

পার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সমৃদ্ধ বাংলাদেশে অনন্য ও আন্তর্জাতিক মানের প্রচুর পর্যটন পণ্য রয়েছে। একটি দেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য আর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পর্যটন অপরিহার্য নিয়ামক। পর্যটনের মাধ্যমে সংশিষ্ট দেশের প্রতি আগত পর্যটকের ইতিবাচক ধারণা জন্মে। এতে পর্যটকের নিকট দেশটির ভাবমূর্তি যেমন বাড়ে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয় সে দেশ। ‘পর্যটন’ অর্থনীতির একটি বিশেষ খাত- বাংলাদেশে এমন ধারণার বিকাশ ঘটে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। তবে আমাদের দেশে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটলেও পর্যটন শিল্পের অবস্থান এখনও অনেক পিছিয়ে। আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ যখন শুধু পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করছে তখন বাংলাদেশের অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়।

বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প
পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে ‘পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি’। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব মতে সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের এর ক্ষেত্রে পরিমান ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে এর পরিমান ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল। মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প
পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন মার্কেটের একটি হিসাবে ভাবা হচ্ছে। ১৯৫০ সালে বাংলাদেশে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন মাত্র, আয় ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। ২০০৬ সালে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪২ মিলিয়নে, আয় হয় ৭৩৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ভ্রমনকারী পর্যটকের সংখ্যা ২০০৩ সালে ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে ২ লাখ ৭১ হাজার, ২০০৬ সালে ২ লাখ ৩১১জন এবং ২০০৭ সালে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ সংখ্যক ২ লাখ ৮৯ হাজার। ২০০৬ সালের শেষের দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটক অনেক কম আসে বাংলাদেশে। ফলে ২০০৬ সালে পর্যটন খাত হতে ৮০.৪৪ মিলিয়ন ডলার আয় হলেও ২০০৭ সালে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৭৫.২২ মিলিয়ন ডলারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি, ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে এই বিপুল সংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলো। বাংলাদেশ যদি বিশাল এ বাজার ধরতে পারে তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতি। তবে পর্যটক আকর্ষণের যাবতীয় উপাদান থাকা সত্ত্বেও যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে । বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটিতে। তথ্যমতে ২০০৮ সালেই পর্যটন থেকে আয় হবে ৮০০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়াও বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্প হতে ২৯ কোটি ৭০ লাখ কর্মসংস্থান হবে, বিশ্ব জিডিপিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ পর্যটন খাত হতে পায় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সাপোর্ট। সকল দিক হতে বাংলাদেশের পর্যটন অপরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়ের অভাব ও কতিপয় সমস্যার কারণে এ খাত এখনও অবহেলিত। ২০০৪-০৫ ও ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে পর্যটন খাতে কোন বরাদ্দ ছিলনা।

সমস্যাসমূহ
- জাতীয় পরিকল্পনায় পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার না দেয়া
- জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ না থাকা
- বিশ্বে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি
- জটিল ভিসা প্রক্রিয়া
- পর্যটকদের নিরাপত্তার অভাব
- নিম্নমানের ও অপর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা
- মানসম্মত আবাসন সমস্যা
- অদক্ষ জনবল
- পর্যটন পণ্যের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাব
- সমনন্বিত পর্যটন আইন কাঠামোর অভাব
- উপযুক্ত বিনোদন ব্যবস্থার অভাব
- সুষ্ঠু পর্যটন নীতিমালার অভাব
- বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ না থাকা

সমাপনী মন্তব্য
সারা দেশের পরতে পরতে ছড়ানো প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, হাজার বছরের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতির সমাহার ও অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিপুল সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে জাতীয় পরিকল্পনায় পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিকল্পিত প্রচারণা চালানো, দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন। এছাড়াও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এ জন্য তাদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা ও ট্যাক্স মওকুফ করা, সর্বোপরি পর্যটন তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। আধুনিক পর্যটন চাহিদা মোতাবেক সমন্বিত ও পরিকল্পিতভাবে পর্যটন শিল্পের উপস্থাপন বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি।