রবিবার, ১ মার্চ, ২০০৯

‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের ভুমিকা’

নাজমুস্ সাকিব অনু
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (৩য় বর্ষ)
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাভার,ঢাকা-১৩৪২

পার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সমৃদ্ধ বাংলাদেশে অনন্য ও আন্তর্জাতিক মানের প্রচুর পর্যটন পণ্য রয়েছে। একটি দেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য আর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পর্যটন অপরিহার্য নিয়ামক। পর্যটনের মাধ্যমে সংশিষ্ট দেশের প্রতি আগত পর্যটকের ইতিবাচক ধারণা জন্মে। এতে পর্যটকের নিকট দেশটির ভাবমূর্তি যেমন বাড়ে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয় সে দেশ। ‘পর্যটন’ অর্থনীতির একটি বিশেষ খাত- বাংলাদেশে এমন ধারণার বিকাশ ঘটে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। তবে আমাদের দেশে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটলেও পর্যটন শিল্পের অবস্থান এখনও অনেক পিছিয়ে। আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ যখন শুধু পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করছে তখন বাংলাদেশের অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়।

বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প
পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে ‘পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি’। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব মতে সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের এর ক্ষেত্রে পরিমান ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে এর পরিমান ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল। মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প
পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন মার্কেটের একটি হিসাবে ভাবা হচ্ছে। ১৯৫০ সালে বাংলাদেশে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন মাত্র, আয় ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। ২০০৬ সালে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪২ মিলিয়নে, আয় হয় ৭৩৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ভ্রমনকারী পর্যটকের সংখ্যা ২০০৩ সালে ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে ২ লাখ ৭১ হাজার, ২০০৬ সালে ২ লাখ ৩১১জন এবং ২০০৭ সালে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ সংখ্যক ২ লাখ ৮৯ হাজার। ২০০৬ সালের শেষের দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটক অনেক কম আসে বাংলাদেশে। ফলে ২০০৬ সালে পর্যটন খাত হতে ৮০.৪৪ মিলিয়ন ডলার আয় হলেও ২০০৭ সালে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৭৫.২২ মিলিয়ন ডলারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি, ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে এই বিপুল সংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলো। বাংলাদেশ যদি বিশাল এ বাজার ধরতে পারে তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতি। তবে পর্যটক আকর্ষণের যাবতীয় উপাদান থাকা সত্ত্বেও যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে । বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটিতে। তথ্যমতে ২০০৮ সালেই পর্যটন থেকে আয় হবে ৮০০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়াও বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্প হতে ২৯ কোটি ৭০ লাখ কর্মসংস্থান হবে, বিশ্ব জিডিপিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ পর্যটন খাত হতে পায় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সাপোর্ট। সকল দিক হতে বাংলাদেশের পর্যটন অপরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়ের অভাব ও কতিপয় সমস্যার কারণে এ খাত এখনও অবহেলিত। ২০০৪-০৫ ও ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে পর্যটন খাতে কোন বরাদ্দ ছিলনা।

সমস্যাসমূহ
- জাতীয় পরিকল্পনায় পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার না দেয়া
- জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ না থাকা
- বিশ্বে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি
- জটিল ভিসা প্রক্রিয়া
- পর্যটকদের নিরাপত্তার অভাব
- নিম্নমানের ও অপর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা
- মানসম্মত আবাসন সমস্যা
- অদক্ষ জনবল
- পর্যটন পণ্যের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাব
- সমনন্বিত পর্যটন আইন কাঠামোর অভাব
- উপযুক্ত বিনোদন ব্যবস্থার অভাব
- সুষ্ঠু পর্যটন নীতিমালার অভাব
- বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ না থাকা

সমাপনী মন্তব্য
সারা দেশের পরতে পরতে ছড়ানো প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, হাজার বছরের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতির সমাহার ও অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিপুল সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে জাতীয় পরিকল্পনায় পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিকল্পিত প্রচারণা চালানো, দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন। এছাড়াও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এ জন্য তাদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা ও ট্যাক্স মওকুফ করা, সর্বোপরি পর্যটন তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। আধুনিক পর্যটন চাহিদা মোতাবেক সমন্বিত ও পরিকল্পিতভাবে পর্যটন শিল্পের উপস্থাপন বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি।

শনিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০০৯

পথের বাঁকে
জুবায়ের হুসাইন


শামসুল হকের মনটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গেছে। তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না কেনো তার মনটা খারাপ হলো। অথচ যে কারণে মন খারাপ, সেটা বড় কোনো বিষয় নয়।
অফিস শেষে বাসে করেই বাড়ি ফিরছেন তিনি। প্রতিদিনকার মতো আজও বাস থেকে নামলেন। এখান থেকে তার বাসা রিকসায় করে গেলে আট টাকা ভাড়া। কিন্তু তিনি কোনোদিনই এই আট টাকা খরচ করেননি। এটাকে তিনি বেহুদা খরচ মনে করেন। অর্থাৎ পায়ে হেঁটেই পাড়ি দেন পথটুকু। অবশ্য মাথার উপর একটা ছাতা মেলানো থাকে- কী বর্ষা, কী রোদ- সবসময়।
পড়ন্তô এই বিকেলে রোদের তেজ না থাকলেও ছাতা বন্ধ করেননি তিনি। হয়ত বা খেয়ালও করেননি যে এখন ছাতা না মেলিয়েও নিশ্চিন্তেô পথ পাড়ি দেয়া যায়। দীর্ঘদিনের অভ্যাস বলেই কথা।
বাস থেকে নেমে কেবল কয়েক কদম এগিয়েছেন তিনি- এই সময়ই ঘটলো ঘটনাটা। পিচঢালা রাস্তôা হলেও এখানে ওখানে খোয়া উঠে গিয়ে ছোট বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। তেমনই একটি গর্তে শামসুল হকের বাম পা পড়ে। আর তাতেই মুহূর্তে মনটা তেতো হয়ে ওঠে তার। ‘উহ!’ করে ব্যথায় ককিয়ে ওঠেন একবার।
মনে মনে গর্তটাকে কষে কয়েকটা গাল দেন তিনি। তবে তার এই গালিতে কোনো অশালীন শব্দ নেই।
এখন একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন মাঝ বয়স ছাড়িয়ে যাওয়া লোকটা। পা’টা বুঝি মচকেই গেলো- ভাবলেন তিনি।
শামসুল হকের মন খারাপের কারণ এটাই।
এর আগে অনেক বড় বড় ঘটনা তার জীবনে ঘটে গেছে। কোনো সময়ই তার এতো মন খারাপ হয়নি। হাসি মুখে সব সহ্য করেছেন তিনি। বুঝতেও দেননি কাউকে তার মন খারাপের কথা। আর আজ কি-না-
আসলে মানুষের মনটা বড়ই বিচিত্র। কখন কি কারণে মন ভালো হয়ে ওঠে, কোন্‌ কারণে মন খারাপ হয় তা বলা মুশকিল। মন নামক জিনিসটার কূল পাওয়ার সাধ্য বোধহয় কারোরই নেই। তাই মন নামক জিনিসটাকে মাঝে মাঝে তার কাছে জটিল এক রহস্য বলে মনে হয়। এ রহস্যের জাল ছিন্ন করতে চেষ্টাও তিনি করেননি।
আকাশে কী আজ মেঘ জমেছে?
মুখ তুলে আকাশপানে তাকান শামসুল হক। কই? নীল আকাশই তো দেখা যাচ্ছে, রোজই যা দেখা যায়। মাঝে মাঝে পেঁজা তুলোর মতো খ ৈখ ৈসাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। হেমন্তেôর মেঘশূন্য আকাশ বলে কথা! কিন্তু তার মন জুড়ে কেনো এতোগুলো কালো মেঘ? ক্রমেই যেনো ভারি হচ্ছে মেঘগুলো। তিনি বুঝতে পারেন না এ কিসের আলামত। কিছুটা ভয়ও পাচ্ছেন তিনি এখন।
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন আকাশ থেকে। কী এক অস্বস্তিôতে তান মনটা ছেয়ে গেছে। প্রচ ৈতেষ্টা পেয়েছে তার। পাশে একটি হোটেল থাকলেও সেখানে গিয়ে পানি খেতে ইচ্ছে করছে না। লাগুক তেষ্টা। পাক কষ্ট।
পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দো’তলায় শামসুল হক তার পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন। স্ত্রী, এক কন্যা ও দুই পুত্র নিয়ে তার সংসার।
আজ এটুকু সিঁড়ি টপকাতেই হাফিয়ে উঠলেন তিনি। পায়ের ব্যথাটা আরো বেড়ে গেছে এই মুহূর্তে।
দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে রীতিমতো হাফিয়ে নিলেন দুই মিনিট। তারপর দরোজায় টোকা দিলেন অভ্যাস মতো। আগে কলিং বেল ছিল, নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তা আর ঠিক করা হয়নি।
দরোজা খুলে দিল রেহানা- শামসুল হকের একমাত্র মেয়ে। ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় সে।
শামসুল হক ভেতরে প্রবেশ করলেন। ‘তোমার মা কই?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘মা একটু শুয়ে আছেন।’ জবাব দিল রেহানা।
‘কেনো, এই অবেলায় শুয়ে কেনো?’
‘না, মানে---’
‘তুমি কি জন্য এসেছো দরোজা খুলতে?’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন শামসুল হক।
চমকে উঠলো রেহানা। একি! বাবা এমন রেগে যাচ্ছেন কেনো? তিনি তো কোনো সময় তার ছেলেমেয়েদের উপর রাগ করেন না। আজ হঠাৎ কি এমন হলো?
‘আব্বা আপনি---’
রেহানা কথা শেষ করতে পারে না, আবার ঝাঁঝিয়ে ওঠেন শামসুল হক, ‘ওভাবে তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? যাও সামনে থেকে! যত্তসব···’ গজ গজ করতে লাগলেন তিনি।
দ্রম্নত কেটে পড়লো রেহানা পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবার আগেই। হন্তôদন্তô হয়ে প্রবেশ করলেন মা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে? মেয়েটাকে ওভাবে বকাবকি করছ কেনো?’
‘বকব না মানে? তোমার মেয়ে একটা---, দিন দিন ধাড়ি হচ্ছে আর---’ বলতে বলতে নিজের রম্নমের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। পেছন পেছন গেলেন রাহেলা বেগম। স্বামীর খুঁড়িয়ে হাঁটা খেয়াল করে বললেন, ‘একি গো! তুমি অমনভাবে খোড়াচ্ছ কেনো? তোমার পায়ে কি হয়েছে?’
শামসুল হক কড়া ভাষায় কিছু কথা বলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই ফেলেছিলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। ছাতাটা একপাশে রেখে খাটে বসে পড়লেন। রাহেলা বেগম জামা-কাপড় পাল্টাতে সাহায্য করলেন। তারপর এক গেলাস ঠাwৈ পানি এনে দিলেন। শামসুল হক নীরবে পান করলেন। রাহেলা বেগম খালি গেলাসটা টেবিলে রেখে এসে স্বামীর পাশে বসলেন। নরম সুরে বললেন, ‘কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ করছে? মাথাটা একটু টিপে দিই?’
শামসুল হক কি বলবেন তা যেনো একটু গুছিয়ে নিলেন। তারপার বললেন, ‘মানুষ এমন কেনো গো?’
‘কেনো একথা বলছ?’
‘রেহানা খুব কষ্ট পেয়েছে, তাই না?’ উত্তরের অপেড়্গা না করে বলেই চললেন, ‘আসলে কেনো যে ওকে বকলাম তা আমি নিজেও জানিনে। বাস থেকে নেমে কয়েক পা এগোতেই একটা গর্তে পা পড়ে মচ্‌কে মতো গেলো, তারপরই মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো। আর সেই রাগ--’
‘তুমি বরং শুয়ে পড়। আমি দেখি জাহানারা ভাবিদের ফ্রিজে বরফ পাওয়া যায় কি না।’ উঠতে গেলেন রাহেলা বেগম।
শামসুল হক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার মনে খুব দুঃখ, তাই না? জীবনে তো কিছুই দিতে পারলাম না তোমাকে। হ্যাঁ, অনেক দুঃখ ও অভাব দিতে অবশ্য পেরেছি। আমি এক ব্যর্থ মানুষ!’ কেমন উদাস হয়ে গেলেন শামসুল হক।
‘এই, কি হয়েছে তোমার সত্যি করে বল তো! আমি কি তোমার কাছে কোনো সময় ওসব সুখ-টুক চেয়েছি? তুমিই তো আমার সুখ আর আনন্দ। আমি তো শুধু তোমাকেই চেয়েছি এবং পেয়েওছি। আর কোনো চাওয়ার নেই আমার। খবরদার! ওসব কথা আর কখনো বলবে না। তাহলে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাবো।’ ধরে এলো রাহেলা বেগমের গলা। ছলছল করে উঠেছে চোখ জোড়া।
‘আচ্ছা রাহেলা, তোমার মনে আছে সেই দিনগুলোর কথা, যখন আমরা গ্রামে থাকতাম। ছোটখাট ব্যবসা করতাম আমি। সকালে বেরিয়ে যেতাম আর সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসতাম। তুমি গরম ভাত হাজির করতে সামনে। আমি খেতাম আর তুমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে। আমি কতবার বলেছি, কিন্তু তুমি কখনও আমার সাথে খেতে রাজি হওনি। বলতে, ‘তোমার খাওয়া না দেখলে আমার মন ভরে না।’ রেহানা তখন সবে পাঁচ বছরে পা দিয়েছে। ওকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা! তুমি ওকে কারণে-অকারণে বকতে। সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরলেই ও এগিয়ে এসে সব নালিশ করত। আমি তোমাকে মানা করতাম আর ও তাতে কত আনন্দ পেত! ওকে আমি আদর করতাম বলে তুমি আমাকে প্রায়ই বলতে, ‘ওকে যে অত মাথায় তুলছ, শেষে নিচে নামাতে পারবে তো?’ আমি বলতাম, ‘দূর! মেয়েকে আদর করব না তো কাকে করব? মেয়ে আমার খুব বুদ্ধিমতি। ঠিক আমার দাদির মতো।’ তোমার মনে আছে রাহেলা?’ এতগুলো কথা একসাথে বলে হাফাতে লাগলেন শামসুল হক।
রাহেলা বেগম বললেন, ‘আমার সব মনে আছে, সঅব! মাঝে মাঝে তুমি বাড়ি ফিরতে রাত করলে আমি রাগ করে তোমার সাথে কথা বলতাম না। তুমি আদর করে আমার রাগ ভাঙাতে। মজার মজার কথা বলতে। লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে যেতো। তুমি সেই লজ্জারাঙা মুখ তুলে নিতে তোমার হাতে। তাতেই সব রাগ পানি হয়ে যেতো আমার।’ তারপর চুপ করে গেলেন। যেনো আর কিছু বলার নেই।
দু’জনেই যেনো কোন্‌ সুদূর অতীতে ফিরে গেছেন। জীবনের এ্যালবাম থেকে খুঁজে ফিরছেন সুখের ফ্রেমে বাঁধা ছবিগুলো। কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও পুলকিত হয়ে উঠলো তাদের উভয়ের হৃদয়। সুখ-সাগরে ভেসে চলল।
হঠাৎ প্রশ্ন করলেন শামসুল হক, ‘আচ্ছা রাহেলা, আমরা গ্রাম ছেড়েছি ক’বছর হলো?’
রাহেলা বেগম বললেন, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন কেনো?’
‘আহা বলোই না।’
‘তা বোধহয় চোদ্দ বছর হবে।’
‘আমরা যখন এই শহরে প্রথম এলাম তখন রাতুলের বয়স তিন বছর আর রাকিব তোমার পেটে। আর এখন আমাদের রাকিবের বয়স বারো চলছে। ও এখন এইটে পড়ছে। অথচ মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। রাকিব ভূমিষ্ট হলো। জানো রাহেলা, আমি সবসময় ইংরেজি ওই কথাটা মনে রাখতাম, ওভ ুড়ঁ ৎঁহ ধ ৎধপব ধমধরহংঃঃরসব,ঃরসব রিষষ রিহ· যদি তুমি সময়ের সাথে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও, তবে সময়ই জয়ী হবে। কিন্তু এখন আর ওসব মনে থাকে না। সবকিছু কেমন ভুলো ভুলো লাগে। আসলে বয়স বাড়ছে তো!’ একটু হাসলেন তিনি, শব্দ না করে। আবার শুরম্ন করলেন, ‘আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো? মনে হয়, তুমি যদি আমার পাশে না থাকতে তাহলে আমি অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে যেতাম। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দেয়া আমার একার পড়্গে কিছুতেই সম্ভব হতো না। আজ তো ছোট একটা গর্তে পা পড়ে পা’টা কেবল একটু মচ্‌কে গেছে, অন্যথায় আরো বড় কোনো গর্তে কবেই হারিয়ে যেতাম আমি।’
‘আহা থাক না ওসব। খালি খালি ওসব অতীত টেনে আনছো কেনো?’ রাহেলা বেগম প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইলেন।
কিন্তু শামসুল হকের আজ কিসে পেয়ে বসেছে, তিনি থামতে পারলেন না। বললেন, ‘অতীত আছে বলেই তো মানুষ বেঁচে আছে। অতীত না থাকলে মানুষের কিছুই থাকতো না। এই দেখ না, অতীত আছে বলেই তো আমরা সেই অতীত থেকে স্মৃতি রোমন্থন করতে পারছি। আসলে প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু সুখের স্মৃতি থাকে যেগুলো কখনও মুছে যাবার নয়। জীবনের কোনো না কোনো বাঁকে মানুষ সেগুলো স্মরণে আনে এবং সেখান থেকে আনন্দের পাশাপাশি অনুপ্রেরণাও সংগ্রহ করে। তোমার কি ভালো লাগছে না এসব মনে করতে?’
‘হ্যাঁ তা লাগছে। কিন্তু খারাপও লাগছে।’
‘খারাপ লাগছে তোমার? কেনো?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রাহেলা বেগম। বললেন, ‘না এমনি বললাম আর কি। আসলে স্মৃতিই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগায়।’
‘রাতুল প্রাইভেট পড়ে এখনও বোধহয় ফেরেনি।’ হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল করেন শামসুল হক। ‘তুমি ওদের দিকে একটু ভালো করে খেয়াল রেখো। আমি তো সময় পাইনে। তুমিও ঢিলা দিলে শেষে বিপথে চলে যেতে পারে।’
‘এ ব্যাপারে তুমি কোনো চিন্তôা কোরো না। আমার ছেলেমেয়রা অমন না। বাপ-মায়ের মনে কষ্ট দেয়ার মতো কোনো কাজই ওরা করবে না, এ আমি জোর দিয়েই বলতে পারি।’
‘সে বিশ্বাস আমারও আছে। আছে বলেই তো এতটা নিশ্চিন্তô থাকতে পারি। কিন্তু সমাজটা তো খুব ভালো না। তাই একটু সতর্ক থাকাই ভালো।’ একটু থামলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, ‘এই দেখ, তোমার সাথে কথা বলে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। এবার যাও, একটু বরফ কোথাও পাও কি-না দেখ। আর শোনো, যাওয়ার সময় রেহানা মাকে একটু পাঠিয়ে দিও আমার কাছে।’
রাহেলা বেগম একটু মুচকি হাসলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন।
রাহেলা বেগম বেরিয়ে যেতেই চিন্তôায় মগ্ন হলেন শামসুল হক। মনটা তার এখন অনেক হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে জগদ্দল একটা পাথর তার বুকের ওপর থেকে নেমে গেছে এইমাত্র। আসলে তার স্ত্রীর কোনো তুলনায় হয় না। এমন স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যেরই ব্যাপার বটে। তিনি ভাগ্যবান। তার জীবনের সুখ-দুঃখগুলোকে রাহেলা বেগম ভাগ করে নেয় বলে কখনও নিজেকে অসহায় মনেই হয় না। চরম সময়েও পরম প্রশান্তিôর পরশ পান তিনি তার স্ত্রীর কাছ থেকে। পথের বাঁকে হঠাৎ আলোর সন্ধান পাওয়ার মতো সামনে এগিয়ে যান তিনি। নব উদ্যমে পা ফেলেন সম্মুখে। স্বপ্ন দেখেন আলোকিত ভবিষ্যতের।
সুখেই আছেন তিনি। স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়ে কেউই তার সামর্থেøর বাইরে কিছু দাবী করে না। ওরা তার পজিশন বোঝে। তিনিও ওদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন।
তবে রেহানাকে নিয়েই তার যতো চিন্তôা। বিয়ের বয়স পার হয়ে গেলেও মেয়ের জন্যে কিছুই করতে পারছেন না তিনি। এই একটা বিষয় তাকে সর্বদা কুরে কুরে খাচ্ছে। চেষ্টাও কম করছেন না। কিন্তু মিলাতে পারছেন না। মেয়ে তার চাপা স্বভাবের। নিজের থেকে কিছুই বলে না। কিন্তু তিনি তো সব বোঝেন। আর বোঝেন বলেই দহনে পুড়তে থাকেন। এখন সবকিছু মহান প্রভুর কাছে সপে দিয়েছেন। তিনিই একটা ব্যবস্থা করে দেবেন নিশ্চয়ই। কেনো দেবেন না? তাকে ডাকতে তো কখনও ভুল হয় না তার। প্রভুকে তার ডাকে সাড়া দিতেই হবে।
বাস্তôবে ফিরে এলেন শামসুল হক। যে মেয়েকে জীবনে কোনোদিন একটা ফুলের টোকাও দেননি, সেই মেয়েকে আজ কি-না তিনি বকেছেন? না না, মেয়েকে বকা তার ঠিক হয়নি। খুবই কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই মেয়েটা। কি করলে ও সব ভুলে যাবে তা-ই ভাবতে রাগলেন তিনি। পেয়েও গেলেন। স্বস্তিôর একটা দীর্ঘশ্বাস তাই তার ফুসফুস থেকে বেরিয়ে এলা।
দরোজার বাইরে পায়ের মৃদু আওয়াজ শোনা গেলো। ওপাশেই থেমে গেল।
শামসুল হক বললেন, ‘আয় মা, ভেতরে আয়।’
ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করল রেহানা। বাবার সামনে এসে জড়সড় হয়ে দাঁড়ালো।
শামসুল হক পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।

যাত্রা শুরু হলো আবর্তন বাংলাদেশ ব্লগের

যাত্রা শুরু হলো আবর্তন বাংলাদেশ ব্লগের। যেসব পাঠক এই ব্লগে লিখতে চান তারা তাদের নিজস্ব ইমেইল এবং নাম ঠিকানা লিখে মেইল করুন। আমরা আপনাকে ব্লগে লেখার সুযোগ দেব।
ধন্যবাদ।
আমাদের ইমেইল ঠিকানা: abortonbd@gmail.com